একটি ট্রলারে মধ্যেই গাদাগাদি করে বসানো হয়েছে ১১৯ যাত্রীকে। যেখানে রয়েছে তিন বছরের শিশু থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধ। অবৈধ উপায়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে আটকদের বৃহস্পতিবার রাত ৭টার দিকে টেকনাফ জালিয়াপাড়া নাফনদী সংলগ্ন জেটি ঘাটে এনেছে কোস্টগার্ড। সেখান থেকে তাদের গাড়িতে করে থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে কোস্টগার্ড সেন্টমার্টিন স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জোসেল রানা বলেন, ‘সাগরে মালয়েশিয়াগামী যাত্রীবাহি একটি ট্রলার সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে ভাসমান অবস্থান রয়েছে, এমন খবর পেয়ে তিনিসহ কোস্টগার্ডের একটি দল সেখানে পৌঁছে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। ট্রলারে চার মাঝিমাল্লাহ ১২২ জন যাত্রী ছিল। তারা সবাই রোহিঙ্গা।
জোসেল রানা বলেন, ‘মানুষের জীবন বাচাঁনো কোস্টগার্ডের দায়িত্ব, সেই দায়িত্ববোধ থেকে যাত্রীবাহি একটি ট্রলার সাগরে ভাসমানের খবর শুনার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার রোহিঙ্গারা জানায়, ইঞ্জিন বিকল হয়ে তিন দিন ধরে তারা সাগরে ভাসছিল। উদ্ধারের সময় তাদের চোখে মুখে আতঙ্ক দেখা গেছে। এর আগে টেকনাফের রাজারছড়া উপকূল দিয়ে উন্নত জীবনের আমায় সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছিল বলে স্বীকার করেন উদ্ধার যাত্রীরা। তাদের টেকনাফ থানায় সোর্পদ করা হয়েছে।
উখিয়া মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যম্পের মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, ‘গত ১১ নভেম্বর গভীর রাতে টেকনাফের রাজাছড়া উপকূল দিয়ে সাগরে নোঙ্গর করে থাকা ট্রলারে পৌঁছায় রোহিঙ্গারা। গিয়ে দেখেন সেই ট্র্রলারে তার মতো আরো অনেকে রয়েছেন। সব মিলিয়ে সাগর পথে মালয়েশিয়াগামী ১১৯ জন যাত্রী ছিল। সেই দিন রওনা দেওয়ার একদিন পর হঠাৎ করে ট্রলারের নিচের তক্তা ভেঙে পানি ঢুকতে শুরু করে। এতে সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
পরিবারের কষ্ট দূর করতে সাগর পথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছেন জানিয়ে এই রোহিঙ্গা বলেন, সেই দিন রাতে পানি ঢুকে ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে। তখন ট্রলারটি ভাসমান ছিল। এভাবে তিন দিন সাগরে ভাসমান থাকার পরে তাদের উদ্ধার করে কোস্টগার্ড।
মো. আনোয়ার নামে নামে আরেক যাত্রী বলেন, বাংলাদেশে আসার পরে কর্মহীন দিন যাচ্ছিল। ফলে দালালের মাধ্যমে অন্যদের মতো সাগর পথে মালয়েশিয়া পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কেননা এনজিও সংস্থাগুলো এখানে যে ত্রাণ দিত তা নিয়ে সংসার চালানো খুবই কষ্ট হতো। তাছাড়া ঘরে দুই বোন বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। কিন্তু টাকার জন্য তাদের বিয়ে দিতে পারছি না।
তিনি বলেন, পরিবারের কথা চিন্তা করে উন্নত জীবনের আশায় সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছিলাম। কিন্তু সেখানেও রোহিঙ্গাদের কষ্টের শেষ নেই। অবশেষে তিন দিন সাগরে ভাসার পর উদ্ধার হয়েছি।
র্যাব-১৫ এর টেকনাফ ক্যাম্পের ইনচার্জ লে. মির্জা শাহেদ মাহতাব বলেন, রোহিঙ্গা মানব পাচারকারীরা টাকায় আশায় সাগরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে মানুষদের। তাছাড়া সচেতনতার অভাবে রোহিঙ্গারা সাগর পাড়ি দিচ্ছে। এই সময় পাচারকারীরা সক্রিয় হওয়া চেষ্টা করে। ফলে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আর যেসব পাচারকারী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে, তাদের ধরতে র্যাবের একটি বিশেষ টিম কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
টেকনাফের লেদা ডেভেলপমেন্ট ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলম বলেন, রোহিঙ্গারা উন্নত জীবনের আশায় মালয়েশিয়া যাওয়ার বা ক্যাম্প থেকে পালানোর প্রবণতা বরাবরই ছিল। এ সময়ে সমুদ্র শান্ত থাকে, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছিল। বেশির ভাগই যাদের আত্মীয়-স্বজন বিভিন্নভাবে মালয়েশিয়ায় গিয়েছে, তাদের মধ্যেই সেদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
দীর্ঘ দিন ধরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করেন এমন এক নারী কর্মকর্তা বলেন, “মানবপাচারের জন্য কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প একটা হাব, যেখান থেকে প্রলোভন দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়া সহজ। ফলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পাচারকারী ও দালালেরা এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “শিবিরগুলোতে অন্যান্য বিষয়ে নজর দেওয়া হলেও তারা যে পাচারের শিকার হতে পারে সে বিষয়ে কোনো সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেই। অল্পবয়সী রোহিঙ্গা নারীদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করছে। এ বিষয়ে তাদের সচেতন করতে উদ্যোগ নিতে হবে।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস বলেন, চার মাঝিমাল্লাসহ আটক ১২২জন রোহিঙ্গাকে যাচাই-বাচাই শেষে স্বস্ব ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হবে।