দেশব্যাপী বধ্যভূমি, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো চিহ্নিত ও সংরক্ষণে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। তা সত্ত্বেও স্বাধীনতার ৪৮ বছরে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত টেকনাফের একমাত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থানটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বিগত সরকারের আমলে স্বাধীনতা বিরোধী স্থানীয় এক নেতা এই শহীদ কবরস্থানটি নিশ্চিহ্ন করতে ব্যর্থ চেষ্টা চালান বলে অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ পৌরসভা মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের কবরস্থানটির ওপর সুপারির হাট বসিয়েছে। এভাবে অযত্ন অবহেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় এই স্থানটি রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ না নিলে এই যাত্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বলে অভিমত সচেতন সমাজের।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার পুরাতন পল্লান পাড়া, হেচ্ছারখাল সদর হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকা, নাইট্যং পাহাড়ের পাদদেশকে বধ্যভূমি হিসাবে ব্যবহার করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ওই সময় জেলার আনাচে কানাচ থেকে স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের ধরে এনে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হতো এসব বধ্যভূমিতে। প্রত্যক্ষদর্শী অনেক স্থানীয় প্রবীণদের মতে তৎকালীন সময়ে এই বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়েছিল অন্তত শতাধিক নিরীহ বাঙ্গালিকে।
টেকনাফের মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক মরহুম মাস্টার আব্দুস শুক্কুর তার জীবদ্দশায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, চকরিয়া কাকারার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল হামিদের মৃতদেহ স্বাধীনতা লগ্নে তার স্বজনরা এই বধ্যভূমি থেকে শনাক্ত করে নিয়ে গিয়েছিল। দেশ দখলদার মুক্ত হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন বিজয় সিংয়ের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী টেকনাফ আগমনের পরবর্তী মুক্তিযোদ্ধারা মিত্রবাহিনীর সহায়তায় ঐতিহাসিক এই বধ্যভূমিটি আবিষ্কার করে ২৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার ছিন্নভিন্ন দেহাবশেষ উদ্ধার করে পৌর কবরস্থান সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠে সমাহিত করা হয়েছিল।
সেক্টর কমান্ডার ফোরামের টেকনাফ উপজেলা শাখার সেক্রেটারি মোজাম্মল হক জানান, তার উদ্যোগে স্বাধীনতার ১০ বছর পর ১৯৮১ সালে টেকনাফ অলিয়াবাদ বিত্তহীন সমবায় সমিতির সহযোগিতায় এই শহীদ কবরস্থানের চারপাশে পাকা বাউন্ডারি দ্বারা তিনটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছিল। যা এখনো কালের স্বাক্ষী হিসেবে অনেকটা ভঙ্গুর অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
তারপর থেকে কোনো ব্যক্তি বা সরকারি প্রতিষ্ঠান এই কবরস্থানটি রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। উল্টো অভিযোগ রয়েছে, টেকনাফ পৌরসভার মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এক প্যানেল মেয়র পৌর ঈদগাঁহ ময়দান সংস্কারের সময় বিভিন্ন অযুহাতে এই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভগুলো ভেঙে ফেলার চেষ্টা করলে স্থানীদের বাধার মুখে তা ব্যর্থ হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বিগত এক মাস ধরে পৌরসভার সুপারি হাটটি আগের জায়গা থেকে সরিয়ে উপজেলার একমাত্র শহীদ কবরস্থানটির ওপর স্থানান্তর করা হয়েছে। শহীদের কবরের ওপর দিয়ে হাটের লোকজনের জুতাপায়ে অবাধ চলাচলে যেমন মুক্তিযুদ্ধের শহীদের অবমাননা করা হচ্ছে, তেমিন তাদের আত্মা কষ্ট পাচ্ছে।
তাছাড়া স্মৃতিস্তম্ভের ওপর সুপারির বস্তার স্তুপে প্রায় সর্বশেষ স্মৃতি চিহ্নগুলোও নড়বড়ে হয়ে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। অথচ কবরের ৫০ ফিটের মধ্যে টেকনাফ থানা ও পৌরসভা কার্যালয়। দেখে মনে হয়, এ বিষয়ে যেন কারো কিছু যায় আসে না।
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানান, নতুন দায়িত্ব নেওয়াতে আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। সংশ্লিষ্টদের ডেকে স্মৃতিস্তম্ভটি রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে সুপারির হাটটি অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কক্সবাজার জেলা সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সেক্রেটারি কমরেড গিয়াস উদ্দীন বলেন, শহীদ কবরস্থানটি ইতোমধ্যে জেলার একটি প্রতিনিধি দল পরিদর্শন করেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বরাবরে স্বারকলিপি দেওয়া হবে। তাতে যদি হাট সরানো না হয় তবে জেলা সেক্টরস কমান্ডার ফোরাম আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবে।